“বাংলাদেশের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত টেকনাফ উপকূলীয় অঞ্চলটি ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর, অপরদিকে মিয়ানমার সীমান্ত। এখানে রয়েছে সীমান্ত বাণিজ্য, পর্যটন, কৃষি, মৎস্য, ও বনসম্পদের বিপুল সম্ভাবনা।
তবে এই অঞ্চল একাধিক সংকটে নিমজ্জিত — মাদকপাচার, বেকারত্ব, জলবায়ু পরিবর্তন, মান সম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব, এবং রোহিঙ্গা সংকটের সামাজিক চাপ।
এই প্রেক্ষাপটে চব্বিশোত্তর বাংলাদেশে টেকনাফের তরুণ সমাজের পক্ষ থেকে মানবিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সুশাসন এই চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে ৮টি দফা সংবলিত এক নতুন টেকনাফ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি-
১. টেকনাফের জন্য টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতি
নীতিগত দিকনির্দেশনা:
• টেকনাফ বর্ডার ইকোনমিক জোন (TBEZ) স্থাপন করে সীমান্ত বাণিজ্য, মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষিপণ্য রপ্তানি ও হস্তশিল্পের বিকাশ।
• স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ‘Youth Start-up Fund’ তৈরি, যেখানে ক্ষুদ্র ঋণ ও এডভোকেসি সহায়তা থাকবে।
• পর্যটনভিত্তিক অর্থনীতি উন্নয়নে টেকনাফ–সেন্টমার্টিন–ইনানী রুটে ইকো-ট্যুরিজম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন।
• মৎস্য ও সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ ও বাণিজ্যিক ব্যবহার উন্নত করতে “ব্লু ইকোনমি হাব” গঠন।
• স্থানীয় কৃষকদের জন্য সেচ ব্যবস্থা ও বীজ সংরক্ষণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা।
২. শিক্ষা, দক্ষতা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন
নীতিগত দিকনির্দেশনা:
• প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ডিজিটাল লার্নিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা।
• মেয়েদের শিক্ষায় স্কলারশিপ ও নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা।
• টেকনাফে উপজেলায় নারী শিক্ষার প্রসারে একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং টেকনাফ সরকারি কলেজে অনার্স কোর্স চালু।
• উচ্চশিক্ষায় বিশেষ বৃত্তি ও প্রণোদনা।
• স্থানীয় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও ডিজিটাল টিচিং টুলস প্রদান।
৩. স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সামাজিক সুরক্ষা
নীতিগত দিকনির্দেশনা:
• টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ১০০ শয্যার হাসপাতাল হিসেবে উন্নীতকরণ।
• প্রতিটি ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিকের ডিজিটাল সেবা ও ওষুধ সরবরাহ জোরদার।
• মাদকাসক্ত পুনর্বাসন কেন্দ্র ও মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং ইউনিট।
• রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রভাব মোকাবিলায় বিশেষ স্বাস্থ্য তহবিল।
• পুষ্টিকর খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তায় স্কুল পুষ্টি কর্মসূচি।
৪. পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু সহনশীলতা
নীতিগত দিকনির্দেশনা:
• গ্রীন টেকনাফ ইনিশিয়েটিভ চালু করে উপকূলীয় বন, প্রবালপ্রাচীর ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ।
• জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পুনর্বাসন ও কৃষি সহায়তা তহবিল।
• নদীভাঙন ও জলোচ্ছ্বাস রোধে দুর্যোগ-সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ।
• পরিবেশবান্ধব মাছ ধরা ও বন ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়ন।
• বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যুব নেতৃত্বাধীন রিসাইক্লিং প্রোগ্রাম।
৫. শান্তি, নিরাপত্তা ও সামাজিক সম্প্রীতি
নীতিগত দিকনির্দেশনা:
• কমিউনিটি পুলিশিং ইউনিটে যুব ও নারীর অংশগ্রহণ।
• সীমান্ত নিরাপত্তা ও মাদক প্রতিরোধে স্থানীয় সচেতনতা অভিযান।
• রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সংলাপভিত্তিক সহাবস্থান কার্যক্রম।
• মানবপাচার প্রতিরোধে নজরদারি ও পুনর্বাসন প্রোগ্রাম।
• সাংস্কৃতিক উৎসব ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করা।
৬. নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী, ৩য় লিঙ্গ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন
নীতিগত দিকনির্দেশনা:
• নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষুদ্রঋণ, প্রশিক্ষণ ও মার্কেট অ্যাক্সেস।
• স্থানীয় রাজনীতিতে ৪০% নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ।
• প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণ।
• নারী নির্যাতন প্রতিরোধে হেল্পলাইন ও আইনি সহায়তা সেল গঠন।
• শিশুদের নিরাপদ খেলার মাঠ ও শিক্ষামূলক ক্লাব প্রতিষ্ঠা।
৭. অবকাঠামো, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি উন্নয়ন
নীতিগত দিকনির্দেশনা:
• টেকনাফ–কক্সবাজার মহাসড়ক উন্নয়ন ও টেকনাফ স্থল বন্দর বন্দর কার্যকর রাখা।
• গ্রামীণ সড়ক, ঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন।
• সোলার এনার্জি ও অফ-গ্রিড বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ।
• ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবা সম্প্রসারণ।
• ডিজিটাল যুব ইনোভেশন ল্যাব গঠন করে স্থানীয় টেক স্টার্টআপ উৎসাহিত করা।
৮. রোহিঙ্গা সংকট: উত্তরণে মানবিক ও নীতিগত কৌশল
নীতিগত দিকনির্দেশনা ও কৌশল:
মানবিক সহায়তা ও স্থানীয় জনগণের ভারসাম্য রক্ষা
• রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের কারণে টেকনাফের স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক ক্ষতি, বন নিধন ও নিরাপত্তা সংকট বিবেচনায় Host Community Support Fund গঠন।
• স্থানীয় জনগণের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থান প্রকল্প বাস্তবায়ন।
• রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য, বন সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও প্রত্যাবাসন নীতি
• জাতিসংঘ, ওআইসি, এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার।
• বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে “Rohingya Repatriation Monitoring Commission” গঠন, যাতে স্থানীয় প্রতিনিধিরাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
• প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তরুণদের শান্তি দূত হিসেবে প্রশিক্ষণ ও সম্পৃক্ত করা।
নিরাপত্তা, সামাজিক সম্প্রীতি ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ
• ক্যাম্প এলাকাকে ঘিরে কমিউনিটি পুলিশিং ও সন্ত্রাসবিরোধী পর্যবেক্ষণ ইউনিট চালু করা।
• স্থানীয় যুবকদের জন্য “Peace Fellowship Program” চালু, যাতে তারা সহিংসতা ও ঘৃণাচার প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে পারে।
• মানবপাচার, মাদক ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে বহুমাত্রিক গোয়েন্দা সমন্বয় ব্যবস্থা।
শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন (অন্তর্বর্তী সমাধান)
• রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শিক্ষার সীমিত সুযোগ ও জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষণ (Life Skills Program) – যাতে তারা নিজ দেশের সমাজে পুনঃএকীভূত হতে প্রস্তুত হয়।
• স্থানীয় জনগণের সঙ্গে শ্রমবাজার প্রতিযোগিতা এড়াতে নিয়ন্ত্রিত কর্মনীতি।
• আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় Joint Development Fund গঠন করে স্থানীয় যুবকদের কারিগরি ও কৃষি প্রশিক্ষণ বাড়ানো।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও অবকাঠামোগত ভারসাম্য
• রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ব্যবহৃত বনজ সম্পদ পুনরুদ্ধারে Green Belt Reforestation Program বাস্তবায়ন।
• বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পানিদূষণ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় এনজিও যৌথ প্রকল্প।
• জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় নতুন বৃক্ষরোপণ ও বিকল্প জ্বালানি (বায়োগ্যাস/সোলার) প্রচলন।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধান: আঞ্চলিক সহযোগিতা ও মানবিক কূটনীতি
• মিয়ানমার, ভারত, চীন ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় সংলাপ কাঠামো (Trilateral Dialogue Framework) গঠন।
• Humanitarian Diplomacy Taskforce তৈরি করে আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি ও তহবিল ব্যবস্থাপনা সমন্বয়।
• রোহিঙ্গা সমস্যাকে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও মানবাধিকার ইস্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
“আমাদের টেকনাফ, আমাদের ভবিষ্যৎ”
এই নীতিপত্রের মূল দর্শন হলো —
একটি টেকসই, নিরাপদ, মানবিক ও সুযোগসমৃদ্ধ টেকনাফ গড়ে তোলা, যেখানে তরুণরাই হবে মূল চালিকাশক্তি।
এক্টিভিস্টা টেকনাফ আয়োজিত ‘Youth Dreams: Our Manifesto, Our Future – Youth-led Dialogue on National Election’ শীর্ষক সেমিনারে টেকনাফকে নিয়ে এনসিপির প্রস্তাবিত পলিসিসমূহ যা মোহম্মদ ওমর ফারুকের উঠে আসে
